পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীগুলির একটি। ১৮৯৫ সালে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল।
এই প্রদর্শনীর বিশেষত্ব কী, হঠাৎ এটা নিয়ে পড়লাম কেন? বা, হঠাৎ এই ভিডিওটা দেখার প্রয়োজন অনুভব করলাম কেন?
আসলে সিনেমা, সিরিজ প্রচুর দেখেছি। কিন্তু এই মাধ্যম বোঝাতে, বা এতে রসিক হওয়াতে তেমন দর আমি নই। 'দর' মানে কী বোঝায়, সেই দিকে গেলাম না। তবে ফেসবুকে বাঙালি আঁতেলদের সাথে জার্গন-ভারী আলোচনাতে অংশ নেওয়াতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তাহলে?
আমি বই পড়েছি বেশ কিছু। যতটা পেরেছি। আবার বই মানে শুধু উপন্যাস, গল্পে সীমাবদ্ধ থাকিনি। জ্ঞানমূলক নন-ফিকশন পড়ার পাশাপাশি সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ, কবিতা নিয়ে লেখা অনেক পড়েছি। এইসব পড়ে বেশ সমৃদ্ধ হয়েছি। গল্প, উপন্যাস পড়ে, এমনিতে যা আনন্দ পেতাম, উপভোগ করতে পারতাম, তার তুলনায় এগুলো পড়ার জন্য আমার সাহিত্য থেকে আহরণ করা আনন্দ, দুঃখ, আরও অন্যান্য নানান জাতের বোধ অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে। অনেক বোধের সৃষ্টিও হয়েছে।
এটা যে শুধু ‘পড়ার’ মাধ্যমে হয়েছে এমন নয়। আরও বইপ্রেমী বন্ধু-বান্ধবী-সুহৃদদের সাথে আলোচনায়-আড্ডায়, নানান রকমের সাক্ষাৎকার দেখে, নানান ইন্টারনেট ফোরামে ঘুরে- এইসব সমৃদ্ধি ঘটেছে। এর জন্য আমি খুব কৃতজ্ঞ।
এসবের জন্য, যেকোনো পড়া গল্প, কবিতা, উপন্যাস - আমাকে নতুন ভাবে ছোঁয়, নতুন ভাবে ধরা দেয়, মনকে নানান রকম ভাবে আন্দোলিত করে, সচেতন মস্তিষ্ককে নানান ভাবে ভাবায়।
শিল্প মাধ্যম তো একটা নয়। চিত্রকলা, ফোটোগ্রাফি, এগুলোও তো শিল্প। চিত্রকর আত্মীয় থাকাতে, শিল্প বিষয়ক উপন্যাস, প্রবন্ধ পড়াতে, ফোটোগ্রাফার বন্ধুরা থাকার প্রভাবে, এসব ব্যাপারেও অন্তত খানিকটা হলেও চোখপ্রাপ্তি ঘটেছে।
এইসব মাধ্যমের সৃষ্টিগুলোও একটু অন্যভাবে ধরা দেয়, সৃষ্টিগুলোকে নিজের নিজস্বতার সাথে মিলিয়ে আত্তীকরণ করতে পারি। সেটা এসব সৃষ্টির সার্থকতা নয়, আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের সার্থকতা।
এখন ফিল্ম বা সিরিজ মেলা দেখলেও সেগুলোকে গল্পের মত দেখি মূলত। “ভিজুয়াল উপন্যাস”। তাই হয়তো সিনেমার চেয়ে সিরিজ বেশি পছন্দ করি। যেমন ছোটোগল্পের চাইতে অনেকটা বেশি সময় উপন্যাসে বুঁদ হয়ে থাকা যায়।
কিন্তু চলচ্চিত্র মাধ্যম শুধু তো তা নয়। চলচ্চিত্র নিজের স্বতন্ত্র মাধ্যম। শুধুমাত্র “ভিডিও উপন্যাস” এটা নয়। এটা যে একেবারে বুঝি না, তা নয়।
যেকোনো মানুষ, যারা স্পাইডারম্যান, মার্ভেল, টার্মিনেটর, আধুনিক ফেলুদা থেকে মালহল্যান্ড ড্রাইভ, গডফাদার, অপুর সংসার, ইনসেপশনে গ্র্যাজুয়েট করে- সেই সব মানুষই অল্পবিস্তর জানে এই সত্যিটা।
কিন্তু যদি আরও গভীরে জানতে চাই? কিছু পড়াশোনা তো করতেই হবে। যেভাবে আমি কোনোদিন কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে না পড়লেও, প্রবন্ধ, অভিজ্ঞতার ঝুলি, পুস্তক সমালোচনা কম পড়িনি। নবম থেকে দ্বাদশে স্কুলের, স্কুলের বাইরের- ভালো বাংলা সাহিত্যের শিক্ষকদের থেকে বাংলা সাহিত্য পড়ে, বুঝে কম ঘন্টা কাটেনি।
যদি সিনেমা বুঝতেই হয়, আরেকটু ভালো ভাবে- একটু পড়াশোনা করতেই হবে।
কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করে বিভিন্ন অনলাইনের রিসোর্স সম্পর্কে শ্রদ্ধা ঢের বেড়ে গেছে। হাত বাড়ালেই UCLA Berkeley, MIT -এর মতো জায়গার পূর্ণাঙ্গ ক্লাস লেকচার, হোমওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্ট সব পাওয়া যায়। তাহলে ফিল্ম নিয়ে একটু পড়াশোনা করার জন্য সেদিকেই হাত বাড়াবো না কেন?
যাহোক, দেখলাম যে আইআইটি মাদ্রাজ একটা ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স দিচ্ছে। কিন্তু সেটা শুধু দেখতেই তো অন্ততপক্ষে আট ঘন্টা সময় লাগবে। তার পরে বাকি কাজ!
এমনিতেই ফিল্ম আমার লাইন না। সাহিত্য পড়তে ভালো লাগে, আবার পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার জন্যও ফার্স্ট ইয়ার অবধি বাংলা পড়তেই হয়- তা কোনো ছাত্র বা ছাত্রী যে বিষয়েই অনার্স নিক না কেন। তাই ঘন্টার পর ঘন্টা দেওয়াই যায়। কিন্তু ফাঁকা সময়ে অতটা সময় বের করব কীভাবে? সে তো সাজতে গুজতে ফিঙে রাজা হয়ে যাবে!
আমার মূল উদ্দেশ্য যখন আরও ভালো ভাবে ছবি দেখা, তখন ছবি দেখাই যদি দু'সপ্তাহ পিছিয়ে দিতে হয়, তাহলে আসল জায়গায় ফাঁক পড়ে যায়!
অতএব আবার ইন্টারনেটের শরণ নিলাম। দেখলাম যে বেশ কিছু চ্যানেল থেকে ফিল্ম অ্যানালিসিস, ফিল্ম হিস্টোরি এর কোর্স দেয়। তাই দেখতে হবে।
তবে কোর্স করার আগে, How to Watch a Film শীর্ষক একটা আর্টিকল পেলাম, একটা ফিল্ম-কেন্দ্রিক ইন্টারনেট ফোরাম থেকে1। সেখানেই আগে ঢুঁ মারলাম। দেখলাম যে, এর বেশ কিছু জিনিস আমি বুঝি। কিছু জিনিস নতুন। তবে যাদের সাহিত্য পড়ার অভ্যাস আছে, ছবি দেখারও অভ্যাস আছে, তাদের কাছে অনেক জিনিসই জানা থাকবে।
তার পরে আমার প্রথম কোর্স প্লেলিস্টের দিকে গেলাম2।
প্রথমেই যে কোর্সটা চালিয়ে দিলাম, সেখানেই চোখে পড়ল রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির একটা উক্তি3-
“I… saw Lumiere’s cinematograph— moving photography. The extraordinary impression it creates is so unique and complex that I doubt my ability to describe it with all its nuances.”
— Maxim Gorky
তাহলে ভাবুন- সাহিত্যিকপ্রবর- জনপ্রিয় ও বহুলপ্রশংসিত ম্যাক্সিম গোর্কি বলছেন- তিনি যা দেখলেন তার সমস্তটা উনি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না! এজন্যই চলচ্চিত্র মাধ্যম স্বতন্ত্র। তা শুধু ভিডিও করা বক্তব্য নয়।
এই প্রদর্শনীরই একটা ভিডিও হল “Baby’s Breakfast”। সর্বসাকুল্যে চল্লিশ সেকেন্ডেরও কম সময় নেয়। আপনি এটা দেখতে পারেন এখনই-
মাত্র ৩৫ সেকেন্ডের ভিডিও। এবং পৃথিবীতে তোলা প্রথম ভিডিওগুলির মধ্যে একটা।
কিন্তু কী এমন আছে এতে? এমন ভিডিও তো তোলাই হয় অনেক। এখনকার এইরকম সাদামাটা সাধারণ একটা ভিডিও তুললে কেউ তো ফিরেও তাকাবে না।
শুধু ভিডিওর মধ্যেই যা দেখলাম, আমার চরম ভালো লাগল।
একটা বাড়ির ব্যাকইয়ার্ড, অর্থাৎ উঠোনে বসে এক দম্পতি তাঁদের বাচ্চাকে খেতে সাহায্য করছেন, এবং নিজেরা খাচ্ছেন।
শুধু এইটুকুই। এর বাইরে আর কিছু নেই।
কিন্তু মন দিয়ে দেখলে আরও অনেক কিছুই ধরা দেয়। এটার মধ্যে কোনো ন্যারেটিভ নেই। কোনো গল্প বা কোনো বার্তা নেই। শুধু চলমান ছবি।
আর একটা গল্পের চেয়ে, বা একটা সিনেমার চেয়ে, বা একটা গানের চেয়ে- একটা মিউজিক্যাল পিস, বা একটা ফোটোগ্রাফ, বা একটা পেন্টিং- দর্শকের উপর অনেকটা বেশি ভার ছেড়ে রাখে। এই সমস্ত মাধ্যমকে বোঝার ভার দর্শক, পাঠক, বা শ্রোতার ওপরেই বেশি।
এই ভিডিওটা যতটা না একটা ফিল্মের কাছাকাছি, তার থেকে বেশি একটা পেন্টিং, বা একটা ফোটোগ্রাফের কাছাকাছি। তাই এটাকে নিজের সাথে মিলিয়ে বা না মিলিয়ে দেখার ভার দর্শকের উপরেই বেশি বর্তায়।
আর শুধু কি তাই?
একটা ভালো সাহিত্যকর্মও পাঠকদের নিজেদের প্রতিফলন রূপেই কি ধরা দেয় না?
“A book read by a thousand different people is a thousand different books.”
― Andrei Tarkovsky
কে পড়ছে, তার ওপর নির্ভর করে কী পড়া হচ্ছে।
এই ভিডিও-ও তাই।
হ্যাঁ, যেখানে ছিলাম। এই ভিডিও -তে কী কী দেখলাম সেটা বলছিলাম। তবে ওই যে বললাম, কে দেখছে, তার ওপরেই নির্ভর করে কী দেখা হচ্ছে। তাই আমি শুধু তাই বলতে পারব, যা আমি দেখলাম। তার বাইরে তো কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই।
এই ভিডিওতে অতি সাধারণ-দর্শন এক দম্পতি তাঁদের বাচ্চাকে নিয়ে খেতে আর খাওয়াতে ব্যস্ত। তারা বেশ গুছিয়ে প্রাতরাশে বসেছে। প্রকৃতি সুন্দর।
হাওয়া দিচ্ছে বেশ ভালোই। পিছনে গাছের পাতাগুলো নাড়া দিচ্ছে, দুলছে। সেই একই হাওয়াতে দুলছে টেবলের আসপাশের গাছপালা। মানুষগুলোর গায়েও হাওয়া লাগছে নিশ্চয়ই। গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষ আমি। আমার কাছে হাওয়া জিনিসটা বেশ উপভোগ্য। আমার গায়েও যেন সে হাওয়া লাগছে। প্রকৃতির সাথে মনটাও বেশ ফুরফুর করছে।
এই ছবিতে দম্পতির দু'জনেই খুব প্রশান্ত, রিল্যাক্সড। কারও হাতে সংবাদপত্র নেই, স্মার্টফোন তো আবিষ্কারই হয়নি। সবাই বর্তমান মুহূর্তে বাঁচছে। অনেক দূরের কোনো চিন্তা, বা খেয়ে উঠেই কোথাও যাওয়ার কোনো চিন্তা কারও দেহভঙ্গিতে নেই। এই পাতলা প্রশান্তি বেশ ছোঁয়াচে। অজান্তে আমার মধ্যেও সংক্রামিত হয়।
বাচ্চাকে নিয়ে খাওয়াতে বসেছে। খাওয়াচ্ছে। নিজেরাও কফি বা চায়ের কাপে কিছু গুলছে, খেয়ে নিচ্ছে। মুখে সবসময় লেগে থাকছে চিলতে হাসি। প্রশান্তি। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। এটা অন্য এক সময়, অন্য এক অর্থনীতির ছবি।
এই দৃশ্যে কোনো বাহুল্য নেই, বা কোনো দারিদ্রও নেই। এটা সম্পূর্ণ অন্য সময়ের ছবি হলেও আমেরিকার ৫০ -এর দশককে মনে করায়। তখনকার ‘Baby Boomer’ প্রজন্ম সহজেই মধ্যবিত্ত জীবনের নাগাল পেত। মানুষ তখন কারখানায় শ্রমিকের কাজ করে নিজের বাড়ি, উঠোন, একটা গাড়ি পেত। এখনকার অনেক মার্কিন ছবিতে এই ‘golden 50s’ উঠে আসে। কখনো বা মেন প্লট হিসেবে, কখনো বা সাবপ্লট হিসেবে, অতীত দেখাতে। এইসব দৃশ্যে ব্যবহার করা আলো, পোশাক আলাদা হয়। এখনকার সময়ের সাথে কনফ্লিক্ট তৈরি করতে এই আগের সময়কে একেবারে নির্মল, উজ্জ্বল করে দেখানো হয়। এই ভিডিও সাদা কালো হলেও আমি তো সোনালি রঙ দেখতে পেয়েছি। একটা দেশের, একটা কালের সোনালি রঙ, একটা ফিল্মি স্টিরিওটাইপের রঙ, একটা সাদাকালো দৃশ্যগুচ্ছ দেখেও মনে নিজের জীবনের সোনালি মুহূর্তগুলো মনে পড়িয়ে দেয়।
অন্যান্য ছবিতে, এখনকার যেগুলো, তাতে পরিচালকেরা শহরের মধ্যে হাওয়া, নির্মল প্রকৃতি, লন (lawn), ইত্যাদি ব্যবহার করেন কোনো অ্যাডভেঞ্চার শেষ হওয়া বোঝাতে, বা কারোর কোনো উপলব্ধিতে পৌঁছানো বোঝাতে। মোটকথা ছবির শেষের দিকে এমন দৃশ্য আসে। এই প্রাকৃতিক হাওয়া, দম্পতির প্রশান্তি যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। একটা হ্যাপি এন্ডিং এর প্রভাব আসে মনে। যে সমস্ত সিনেমায় পাশ্চাত্য দেশের এরকম বাড়ির পাশের প্রকৃতি দেখেছি, যখন দেখেছি, নিজের যে অবস্থায় দেখেছি, সেইসব সিনেমার দৃশ্যরচনা, ক্যানভাস, মনের যে যে অবস্থায়, যে যে ভাবের জন্ম দিয়েছিল, সেই সমস্ত ভাবের একটা সংমিশ্রণ, লিনিয়ার বা নন-লিনিয়ার একটা কম্বিনেশন আবার মনের মধ্যে উদয় হয়।
এই এক মিনিটের ভিডিও দেখে আমার এগুলোই মনে হয়েছে।
আরও অনেক কিছু দেখার আছে, অনেক কিছু শেখার আছে। দেখি ভালো ছাত্র হতে পারি কি না, ভালো দ্রষ্টা হতে পারি কি না।
যাঁরা লেখাটা পড়ছেন, তাঁরা সাবস্ট্যাকে সাবস্ক্রাইব করলে খুব ভালো লাগবে। এই নিউজলেটার চিরকালের জন্য বিনামূল্যের ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যবিহীন। এখানে শুধু ইমেল আইডি জমা দেওয়া ছাড়া কিচ্ছু করা লাগবে না।
যদি মনে হয় লেখাটা পড়ে অন্য কারও ভালো লাগতে পারে, শেয়ার করেন।
(Cover Photo- Photo by Catherine Kay Greenup on Unsplash)
https://old.reddit.com/r/TrueFilm/comments/189rpk5/learning_to_analyze_and_appreciate_film/
https://www.youtube.com/playlist?list=PLQhSzXVuPKKWrvV4wy4iyvWxacmSRTPyA